‘জিতা তাখতে আমার পুতরে ছইতাম পারছি না’-সাংবাদিক তুরাবের মায়ের আফসোস

Daily Ajker Sylhet

দৈনিক আজকের সিলেট

৩০ জুলা ২০২৪, ০৬:০৬ অপরাহ্ণ


‘জিতা তাখতে আমার পুতরে ছইতাম পারছি না’-সাংবাদিক তুরাবের মায়ের আফসোস

বিয়ানীবাজার সংবাদদাতা:
‘জুম্মার নামাজও গেছলা। নামাজ থাকি আর ফিরিয়া আইছইন না। নামাজ থাকি লাশ ওইয়া ফিরল। সখালে নাশতাও ঠিকমতো খাইছলা না আমার পুতে। খবর পাইয়া ইবনেসিনাত গেছি, চাইয়া খইছইন, আমার আম্মা আইছইন। ওউ খইছইন। শেষ খতা। আর ইতাত রক্ত যার। খালি আত দিতাম চাইছি। বেটাইনতে আমারে টানিয়া হরাইলিছইন। জিতা তাখতে আমার পুতরে ছইতাম পারছি না।’

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় সিলেট নগরের যতরপুরের ভাড়া বাসায় গেলে এসব কথা বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন মমতাজ বেগম (৬৭)।

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে সিলেটে ১৯ জুলাই শুক্রবার বাদ জুমা বন্দরবাজারে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সাংবাদিক এ টি এম তুরাবের মা মমতাজ বেগম। তুরাব দৈনিক নয়াদিগন্তের সিলেট ব্যুরোর রিপোর্টার ও স্থানীয় দৈনিক জালালাবাদ পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তুরাবের পিতা একাধিকবার বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

ছেলের মৃত্যুর আট দিনেও স্বাভাবিক হতে পারেননি মমতাজ। এমনিতে বয়সজনিত নানা রোগে ভুগছেন তিনি। আদরের ছেলেকে এভাবে হারিয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছেন। বারবার বিলাপ করছেন ও মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। বাসায় কেউ গেলেই প্রশ্ন করছেন, ‘আমার পুয়ারে পুলিশে খেনে মারল, আমার পুয়ার অপরাধটা কিতা?’

এ সময় তুরাবের বড় ভাবি তাসলিমা জান্নাত বলেন, ‘তুরাবরা তিন ভাই, এক বোন। স্বামীর সঙ্গে বোন লন্ডনে থাকেন। যতরপুরের ১০৫ নম্বর বাসার তৃতীয় তলায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকতেন তুরাব। ভাই-বোনদের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। সবার আদরের তুরাবকে হারিয়ে পরিবারের আলো নিভে গেছে।’

তুরাবের গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে। তার গ্রামের বাড়ির লোকজন এখনো শোকের দখল বয়ে চলেছেন। ২০২১ সালে মারা গেছেন বাবা মাস্টার আব্দুর রহিম। ২০ জুলাই গ্রামের বাড়িতেই তাঁর দাফন হয়।

পরিবারের সদস্যরা জানায়, মাত্র দুই মাস আগে বিয়ে হয়েছিল এ টি এম তুরাবের। বিয়ের কিছুদিন পর যুক্তরাজ্যে চলে যান তাঁর স্ত্রী তানিয়া ইসলাম। তুরাবকেও সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য দ্রুত প্রক্রিয়া শুরু করেন তানিয়া। কিন্তু তা আর হলো না।

পরিবারের অভিযোগ, সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় তুরাবের মৃত মুখও তাঁর প্রবাসী স্ত্রী দেখতে পারেননি বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।

তুরাবের বড় ভাই আবুল আহসান মো. আজরফ (জাবুর আহমদ) বলেন, ‘গত ১৩ মে বিয়ে করেন তুরাব। ৫ জুন তাঁর স্ত্রী তানিয়া ইসলাম লন্ডন চলে যান। স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে সেখানে তানিয়া মুষড়ে পড়েছেন। এখনো স্বাভাবিক হননি। কাঁদতে কাঁদতে শেষ।’

জাবুর আহমদ বলেন, ‘তুরাবের মৃত্যুর খবর শুনেই তানিয়া দেশে আসার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ফ্লাইটের টিকিট না পাওয়ায় আসতে পারেননি। এমনকি ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় শেষবারের মতো স্বামীর মুখও দেখতে পারেননি।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ১৯ জুলাই শুক্রবার বাদ জুমা নগরের বন্দরবাজার এলাকা থেকে মিছিল বের করেন বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আচমকাই সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায় তাঁদের। পুলিশ মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ছোড়ে। ওই দিন আরও কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে সেখানে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন তুরাব। আচমকা সংঘর্ষ শুরু হলে তৎক্ষণাৎ নিজেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পারেননি তিনি।

সংঘর্ষ শুরুর কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত সহকর্মীরা দেখেন তুরাব মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। তাঁকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান সহকর্মীরা।

পরে সেখান থেকে তুরাবকে নগরের সোবহানীঘাট এলাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওই দিনই সন্ধ্যায় ইবনে সিনা হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তুরাবের মৃত্যু হয়।

এদিকে তুরাব নিহত হওয়ার ঘটনার ছয় দিন পর গত বুধবার রাতে এসএমপির কোতোয়ালি থানায় একটি এজাহার দাখিল করেন তাঁর ভাই আবুল আহসান মো. আজরফ। এজাহারে তুরাবের মৃত্যুর জন্য পুলিশকে দায়ী করা হয়। অজ্ঞাতপরিচয় ৮ থেকে ১০ জন পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করে এজাহার দিলে পুলিশ সেটি গ্রহণ করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে নথিভুক্ত করেছে।

এ বিষয়ে এসএমপির উপকমিশনার (উত্তর) অতিরিক্ত ডিআইজি আজবাহার আলী শেখ বলেন, ‘সাংবাদিক তুরাবের মৃত্যুর ঘটনায় আগেই পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেছে। নিহতের ভাই জাবুর বাদী হয়ে আরেকটি এজাহার দিয়েছেন। আমরা সেটাও গ্রহণ করেছি। দুটি একসঙ্গে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত ডিআইজি আজবাহার বলেন, এজাহার বা অভিযোগ যে কেউই, যে কারও বিরুদ্ধে করতে পারে। তদন্ত চলছে, পুলিশের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে অবশ্যই আইনানুগ ও বিভাগীয় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

এদিকে তুরাবের মৃত্যুতে বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের উদ্যোগে কালো ব্যাজ ধারণসহ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মিলাদ মো: জয়নুল ইসলাম এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে তুরাবের মৃত্যুর সুষ্টু তদন্ত ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবী জানিয়েছেন।

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 991 বার