অধস্তন আদালতে সহিংসতা-অপ্রীতিকর ঘটনায় উদ্বেগ
১৮ জানু ২০২৩, ০৭:১২ অপরাহ্ণ
স্টাফ রিপোর্টার:
ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অধস্তন আদালতে বিচারকদের সঙ্গে আইনজীবীদের অশোভন আচরণসহ একের পর এক সহিংসতা ও অপ্রীতিকর ঘটনায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বিচারাঙ্গনে। গত দুই মাসে কয়েকটি জেলায় আদালতের নথি চুরি এবং বিচারকক্ষে দুর্বৃত্তের ব্লেডের আঘাতে পুলিশের রক্তাক্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আদালতের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিচারকদের অনেকেই প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
এ অবস্থায় অধস্তন আদালতের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, আইজিপিসহ দেশের সব আদালতের বিচারকদের প্রতি ১১ দফা নির্দেশনা জারি করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। এতে সব আদালতের এজলাসে সিসিটিভি স্থাপনসহ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য বলা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নির্দেশক্রমে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে এ নির্দেশনা জারি করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ‘অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রধান বিচারপতি গভীরভাবে উদ্ব্বিগ্ন।’
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘নির্দেশনাগুলো আমরা দেখব। প্রধান বিচারপতি কেন উদ্বিগ্ন, সেটা নিয়েও আমরা আলোচনা করব এবং ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, পিরোজপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবু জাফর মো. নোমান গত ১৯ সেপ্টেম্বর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) খান মো. আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে খারাপ আচরণের অভিযোগ এনে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে চিঠি দেন। পরে প্রধান বিচারপতি লিখিত অভিযোগটি নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন। এর পর আলা উদ্দিনকে হাইকোর্টে হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছিল। তিনি আদালতে হাজির হয়ে ক্ষমার আবেদন করেন।
গত ২২ সেপ্টেম্বর খুলনা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক (বর্তমানে যুগ্ম জেলা জজ) নির্মলেন্দু দাশের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ঘটনায় খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলামসহ তিন আইনজীবীর বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেওয়া হয়। পরে সাইফুলসহ তিন আইনজীবীকে তলব করেন হাইকোর্ট। তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুলও জারি করা হয়। ২৩ নভেম্বর হাইকোর্টে হাজির হয়ে ক্ষমা চাইলে তা মঞ্জুর করা হয়।
এর পর গত ২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুকের এজলাসে হট্টগোলের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। পরে সংশ্নিষ্ট বিচারকের পক্ষ থেকে বিষয়টি লিখিত আকারে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনকে জানানো হয়। এর পর প্রধান বিচারপতির নির্দেশে অভিযোগের বিষয়টি বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে পাঠান সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল।
এরই ধারাবাহিকতায় ৫ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর আহমেদ ভূঞা, সম্পাদক (প্রশাসন) মো. আক্কাস আলী ও জুবায়ের ইসলামকে তলবসহ রুল জারি করেন হাইকোর্ট। আজ তাঁদের হাইকোর্টে হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার দিন ধার্য রয়েছে।
এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা জজ শারমিন নিগারের সঙ্গেও সম্প্রতি আইনজীবীদের তির্যক বাদানুবাদের ঘটনা ঘটে। তাঁর বিরুদ্ধে অশালীন স্লোগান দেওয়ায় জেলার ২১ আইনজীবীকে আগামী ২৩ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, এসব ঘটনায় অধস্তন আদালতের বিচারকরা এজলাসে সিসিটিভি স্থাপনসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। এর মধ্যে ১৪ জানুয়ারি রাজবাড়ী আদালতের ৩২ মণ ১০ কেজি নথি গোপনে কেজি দরে বিক্রির ঘটনা ঘটে। অবশ্য এটা জানাজানি হওয়ার পর ওই দিন রাতে সেগুলো ভ্যানে করে ফেরত আনা হয়।
অন্যদিকে, গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ আদালতে ৯ মাসের ব্যবধানে ফের নথি চুরির ঘটনা ঘটে। এর আগে গত ২০ ও ২১ মার্চ পরপর দুই রাতে সিরাজগঞ্জ পুরোনো কালেক্টরেট ভবনে ভিপি (ভেস্টেট প্রপার্টি-অর্পিত সম্পত্তি) কৌঁসুলিদের কক্ষের তালা ভেঙে কয়েকটি আলমারি থেকে অন্তত ৬০০ মামলার নথি চুরি করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া বেশ কিছু পুরোনো ডায়েরিও গায়েব হয়ে যায়। এর পর ২২ মার্চ রাতে আবারও চুরির চেষ্টা হয়।
এসব ঘটনায় করা মামলা বর্তমানে বিচারাধীন। এ ছাড়া ১২ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এজলাসে বহিরাগতের ব্লেডের আঘাতে মো. আলী (৫৭) নামের এক কনস্টেবল জখম হন। এর আগে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হামলায় বিচারক ও পুলিশের মৃত্যুসহ নানা সহিংসতা ঘটেছে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা :এতে বলা হয়েছে, অধস্তন দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমাগুলোর নথিতে বিচারপ্রার্থী জনগণের মূল দলিল/ডকুমেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র থাকে। আদালতের হেফাজতে থাকা এসব দলিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র চুরি/নষ্ট হলে আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। এ জন্য প্রধান বিচারপতি নির্দেশনা জারি করেছেন।
এর মধ্যে রয়েছে- আদালত ও বিচারকদের বাসভবনের সীমানাপ্রাচীর সুসংহত করা; আদালত ও ট্রাইব্যুনালের এজলাস, বিভাগ, প্রতিটি ফটক ও আদালতের বাইরে সিসিটিভি স্থাপন করা; আদালত ভবনের বাইরে ও ভেতরে নিরাপত্তা প্রহরী দ্বারা সার্বক্ষণিক পাহারা দেওয়া; আদালত ভবনের দরজা ও জানালাগুলো গণপূর্ত বিভাগের পরীক্ষার পর গ্রিল আরও মজবুত করা এবং ভঙ্গুর দরজা ও জানালাগুলো নতুন করে স্থাপন করা।
আদালত চত্বরে পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করা; মামলা-সংশ্নিষ্ট নথিপত্রের নিরাপদ সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা করা; আদালতে মানসম্মত ফার্নিচার/লকার নিশ্চিত করা; আদালত সীমানার চারদিকে সিকিউরিটি পোস্ট স্থাপন করা; জরুরি ভিত্তিতে সারাদেশের আদালত এলাকায় রাতে সার্বক্ষণিক পুলিশের টহল জোরদার করা।
অবকাশকালীন আদালত ভবনের বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা; প্রতিটি আদালত ও ট্রাইব্যুনালের কর্মকালে পর্যাপ্ত পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করা। নির্দেশনাগুলো সংশ্নিষ্টদের বাস্তবায়নের জন্য বলা হয়েছে।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার