নির্বাচনের বছরে কূটনীতির হটস্পট ঢাকা

Daily Ajker Sylhet

দৈনিক আজকের সিলেট

১৫ জানু ২০২৩, ০৬:৪১ অপরাহ্ণ


নির্বাচনের বছরে কূটনীতির হটস্পট ঢাকা

স্টাফ রিপোর্টার:
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এবার আগেভাগেই সরগরম হয়ে উঠেছে কূটনৈতিক পাড়া। গেল কয়েক মাসে ঢাকায় প্রভাবশালী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক ও জাঁদরেল কর্মকর্তাদের আনাগোনা বেড়েছে।

শনিবার (১৪ জানুয়ারি) ঢাকায় এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। পাকিস্তানে তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সরকার পতনের পেছনে এই কূটনীতিক কলকাঠি নেড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ইমরান খান।

আগামী ২০ জানুয়ারি আসছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ের ফেলিপ গঞ্জালেজ। গত ৯ জানুয়ারি ঢাকায় চক্কর দিয়ে গেলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গ্যাং। আফ্রিকা যাওয়ার নিয়মিত রুট না হওয়ার পরও তিনি যাত্রাবিরতির কথা বলে ৫২ মিনিটের জন্য ঢাকায় নেমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ১০ দিনের মাথায় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকায় এমন ঝটিকা সফর নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন।

এদিকে চলতি বছরের যেকোনো সময় বাংলাদেশ সফরে আসার কথা সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের। এ ছাড়াও এ বছর যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে নির্বাচনী এই বছরে ঢাকা হয়ে উঠবে ‘কূটনীতির হটস্পট’। বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যেসব তৎপরতা শুরু হয়েছে তা নিয়েই বছরজুড়ে ব্যস্ত সময় কাটবে সরকারের।

নির্বাচনের এই বছরটা অবশ্য শুরুই হয়েছে নানামুখী কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে। বিদায়ি বছরের শেষ মাসে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পূর্বাপর এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার পাল্টাপাল্টি সেই চ্যালেঞ্জে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন পরাক্রমশালী দেশের কূটনীতিকদের প্রকাশ্য মন্তব্য ও তৎপরতা সরকারের অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ বছর বন্ধুত্ব বাড়ানো এবং বজায় রাখার কূটনীতিতে জোর দিচ্ছে সরকার। লক্ষ্য একটাই নির্বাচনী বছরে যেন কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি না ঘটে। দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করতে সংশ্লিষ্ট মিশনপ্রধানদের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।

সরকারের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দলীয়ভাবে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। পিছিয়ে নেই বিএনপি এবং সরকারবিরোধী অন্য দলগুলোও। আগামী নির্বাচনে বিশ্বশক্তির সমর্থন পক্ষে টানতে তারাও সক্রিয়।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব ঘাটতিগুলোর দিকে তাকানো দরকার। আমাদের যদি নেতৃত্বের ঘাটতি থাকে, দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র চর্চার ঘাটতি থাকে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ঘাটতি থাকে তা হলে সেগুলো আরও ভালোভাবে চিন্তা করা দরকার। কারণ বিদেশিরা পদক্ষেপ নিলে তা বিভাজন আরও বাড়াবে। তাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও কঠিন হবে। যদি সত্যই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমাদের সদিচ্ছা থাকে, তা হলে ভাবার সময় এসেছে দেশের জনগণ ও নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলগুলোই সম্মিলিতভাবে সংকট সমাধান করবে।’

 

অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জোর সরকারের : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় নতুন ধারার কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে এক জটিল সমীকরণের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশও সেই বাস্তবতার বাইরে নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই দোলাচলে সব দেশের সঙ্গে সুষমভাবে সুসম্পর্ক রক্ষার বিষয়টিও অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ যে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায়, তা হচ্ছে ‘সম্পর্ক রক্ষা ও উন্নয়নের কূটনীতি’; যেখানে প্রাধান্য পাবে অর্থনৈতিক সুযোগ-সম্ভাবনা ও সংকটের বিষয়গুলো।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও কূটনীতিকরা বলছেন, অর্থনৈতিক কূটনীতিতে বাংলাদেশকে সফল হতে হলে বৈশ্বিকভাবে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়ন সহযোগী গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গত এক যুগের অগ্রগতি ও উন্নয়নের সূচক বিবেচনায় বিশ্বের বহু পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের কাছে অর্থনৈতিক কূটনীতির জন্য বাংলাদেশ অত্যন্ত আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এ সুযোগ বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজে লাগানো গেলে সম্পর্ক উন্নয়নের কূটনীতিতেও সফল হওয়ার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী বছরে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জোর দেওয়ার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন, তা সময়োপযোগী এবং যথার্থ বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনের বছরে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ বাড়তে পারে। নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশগুলোকে এ ধরনের চাপ পোহাতে হয়। প্রভাবশালীরা চাপ নিয়ে নিজেদের প্রভাববলয় অটুট রাখার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধাও নিতে চায়। সেই চাপ মোকাবিলা করে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে অর্থনৈতিক কূটনীতির দক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থ সময়ে এ কূটনীতিতে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। এ মুহূর্তে তিনিই এশিয়ার সবচেয়ে অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক। ধারাবাহিকভাবে তিনি বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে ক্রমাগত অগ্রগতি ও উন্নতির পথে এগিয়ে নিচ্ছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক কূটনীতিতে সফলতা পাবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, মূলত ২০১৮ সাল থেকে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। যেসব দেশে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে, তা শতভাগ কাজে লাগানোই এ কূটনীতির প্রধান লক্ষ্য। একই সঙ্গে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী লাভজনক, নির্ভরযোগ্য ও সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টাও থাকবে। নির্বাচনী বছরে দেশে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ কম আসে। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোটের আগে দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। বছরজুড়ে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা চলবে।

নির্বাচনী বছরের কূটনীতি নিয়ে কথা হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এবারই নতুন নয়, বাংলাদেশ আরও আগে থেকেই অর্থনৈতিক কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কারণ, বিশ্ব কূটনীতির এখনকার মূল বিষয়ই হচ্ছে অর্থনৈতিক কূটনীতি।

 

নজর প্রভাবশালী দুই দেশের তৎপরতার দিকে : সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, অর্থনৈতিক কূটনীতিতে সাফল্য পাওয়ার পথে বিপত্তিও রয়েছে বিস্তর। বিশেষ করে বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তির মুখোমুখি অবস্থানের কারণে চাপ বাড়ছে। কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপড়েন অনেকটাই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এর মধ্যেই গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহীনবাগে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ বিএনপি নেতার বাসায় গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখে পড়েন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এ ঘটনায় কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে নিজ দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতাও জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিবৃতি দেয় ঢাকার রাশিয়া দূতাবাস। টুইটারে সেই বিবৃতির জবাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। পরে বিষয়টি নিয়ে পাল্টা প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছে রাশিয়ার দূতাবাস।

শুধু ঢাকায় অবস্থিত দূতাবাস থেকেই নয়, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মুখেও সাম্প্রতিক সময়ে বারবার উচ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশের নাম। দুই দেশের পাল্টাপাল্টিতে পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে রূপ ধারণ করেছিল যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন জোরালো গলায় বলতে বাধ্য হয়েছেন, বাংলাদেশ চায় না যুক্তরাষ্ট্র কিংবা রাশিয়া কেউই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নাক গলাক। এটা তাদের বিষয় নয়।

মুখে এমন কথা বললেও পরাক্রমশালী এ দুই দেশের পাল্টাপাল্টি তৎপরতার দিকে সরকার সতর্ক নজর রেখেছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তারা জানান, বাংলাদেশ কারও সঙ্গেই সম্পর্কের অবনতি চায় না। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলেছেন। পিটার হাসের সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল তা-ও সবিস্তারে তুলে ধরেছেন।

এ নিয়ে এখন আর ভুল-বোঝাবুঝি নেই দাবি করে ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিবাদে জড়াতে চায় না বলে দেশটির নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়ার জাহাজকে বন্দরে ভিড়তে দেয়নি বাংলাদেশ। রাশিয়ার ক্ষেত্রেও কূটনৈতিকভাবে এমন দৃঢ়তা বজায় থাকবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর জাতিসংঘে এ-সংক্রান্ত ভোটাভুটিতে বাংলাদেশ বিচক্ষণতা দেখিয়েছে। সামরিক ইস্যুতে ভোটদানে বিরত থাকলেও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে ভোট দিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে বাংলাদেশ।

একই সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত, বড় উন্নয়ন সহযোগী জাপান, বন্ধুরাষ্ট্র চীন ও ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সহায়তা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট রাখতে এবং ক্ষেত্রবিশেষ ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো।

বাণিজ্যের আওতা বাড়ানোর লক্ষ্য : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ছড়িয়েছে তা চলতি বছরে আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে বারবার সতর্ক করেছেন, এ অস্থিরতার কারণে বিশ্বজুড়ে মন্দা হতে পারে। যদিও গত বছরের শেষ দিকে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি প্রায় ১৭ শতাংশ বেড়েছে।

ফলে মন্দার শঙ্কা কিছুটা হলেও কমেছে। তারপরও নতুন বাণিজ্যিক মিত্রের খোঁজে সরকারের তৎপরতা চলছে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কিছু দেশে খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি এবং বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া এশিয়া ও ইউরোপের অনেক দেশে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য উৎপাদন ও সেবা খাতে লাভজনক বাণিজ্যের হাতছানি রয়েছে বাংলাদেশের সামনে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক সহায়তা বিভাগের উদ্যোগে একটি কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। তবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন খুব একটা এগোয়নি। এ বছর আবারও সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছে সরকার। সুযোগ থাকার পরও উচ্চ শুল্কের কারণে ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশে পণ্য রপ্তানি লাভজনক হবে না। তাই এ বছরে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্যের জন্য শুল্ক হ্রাস ও শুল্কমুক্ত সুবিধা নিশ্চিতের চেষ্টা চলবে।

বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার চেষ্টাও অব্যাহত থাকবে বছরজুড়ে। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করে তুলতে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনগুলোকে ব্যাপকভিত্তিক প্রচার চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আগামী মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বিজনেস সামিট সফল করতে তিন মাস ধরে প্রচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সঙ্গে চুক্তি করেছে এফবিসিসিআই।

ওই সামিটে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মহাপরিচালক, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রেড কমিশনার, জাপানের বহির্বাণিজ্যবিষয়ক সংস্থা জেটরোর চেয়ারম্যানসহ বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে এমন ৩০টির বেশি দেশের মন্ত্রীসহ শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।

 

দলীয়ভাবেও তৎপরতা চালাবে আওয়ামী লীগ : নির্বাচনের বছরে সরকারের পাশাপাশি দলীয়ভাবেও কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকদের নানা ধরনের বক্তব্য নিয়েও ভাবতে হচ্ছে দলটিকে। তবে এ ক্ষেত্রে কাউকে খুব বেশি ছাড় না দেওয়ার পথেই হাঁটবে ক্ষমতাসীন দল। তেমনই ইঙ্গিত মিলেছে আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ জমিরের বক্তব্যে।

নির্বাচনী বছরের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমাদের দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো বলেছেন কীভাবে নির্বাচন হচ্ছে, তা দেখতে চাইলে তারা (বিদেশিরা) পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারবেন। দলের পক্ষ থেকে আমরা তাদের বলেছি তোমাদের অধিকার আছে যেকোনো দেশের নির্বাচন দেখার, কিন্তু মন্তব্য করা যাবে না। মন্তব্য করতে চাইলে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেতে হবে। এসব নিয়ে মিডিয়ায় কথা বলা ঠিক হবে না। নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকদের মন্তব্য করার যথার্থ জায়গা হচ্ছে মন্ত্রণালয়।’

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের অতি-উৎসাহের সমালোচনা করে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘আমরা তাদের (বিদেশিদের) জিজ্ঞেস করেছি তোমাদের দেশে কি সব সময় যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হচ্ছে? সুইডেন, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স কিংবা ইতালিতে হয়েছে? ফ্রান্সে মারামারি হয়নি!’

দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন অনেক উন্নত দাবি করে ড. জমির বলেন, ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) বলেছি তোমরা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যার স্বীকৃতি দিলেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে, তার তো স্বীকৃতি দাওনি। তোমাদের দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?’

প্রবীণ এই কূটনীতিক পিটার হাসের কর্মকাণ্ড নিয়ে বলেন, ‘তারা এত কিছু বলে, এত কিছু করে অথচ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যাননি। কিন্তু বিএনপির কোন নেতা নাকি সমর্থক, যাকে ৯ কিংবা ১২ বছর ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তার বাসায় দেখা করতে গেলেন! আমাদের কথা স্পষ্ট- সার্বিকভাবে কাজ করতে চাইলে তোমাদের সবকিছুই বিবেচনায় নিতে হবে। সবকিছু বিবেচনা করে কথা বলতে হবে।’

 

যা ভাবছে বিএনপি : কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারের বিরুদ্ধে নানামুখী প্রচার অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। বাংলাদেশের মানবাধিকার ও নির্বাচন বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলো যে ভূমিকা নিয়েছে; তার নেপথ্যে বিএনপির প্রচারের ভূমিকা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। নির্বাচনের আগে বছরজুড়ে বিএনপির এসব তৎপরতা চলমান থাকবে তা বলাই বাহুল্য। যদিও বিষয়টি নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে চান না দলটির নেতারা।

তবে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপকে বিএনপি কীভাবে দেখছে- তা জানতে চাইলে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় নির্বাচনকে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ নির্বাচনের সঙ্গে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, প্রশাসনসহ যেসব বিষয় জড়িত তা সারা বিশ্বের মানুষের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। সুশাসন ও গণতন্ত্র না থাকলে কেবল বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা তো না, বাংলাদেশে সুশাসনের অভাব বিশ্বের অন্য অনেক দেশ ও স্থানকেও প্রভাবিত করতে পারে। এটা আজ স্বীকৃত বিষয়। কেবল গায়ের জোরে অভ্যন্তরীণ বিষয় বললে হবে না।’

বিদেশি কূটনীতিকদের ভূমিকার প্রতি বিএনপির যে সমর্থন রয়েছে, তা-ও বোঝা যায় দলটির সিনিয়র এই নেতার এ কথায়- ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র-সুশাসন থাকবে কি না, মানবাধিকার রক্ষিত হচ্ছে কি না, এসব অভ্যন্তরীণ বিষয় হলে সমস্যা আরও প্রকট হবে। দেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র ফেরাতে আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রগুলো কথা বলছে। এতে দোষের কিছু নেই।’

বিএনপি কোনোভাবে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিচ্ছে কি না, জানতে চাইলে মঈন খান বলেন, ‘মানবাধিকার-সুশাসন এগুলো অভ্যন্তরীণ বিষয় হতে পারে না। রাজনীতিক হিসেবে কারও সঙ্গে দেখা করা যাবে না, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা রয়েছে নাকি? রাজনীতিবিদদের কথা বাদ দেন, দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যখন বিদেশে গিয়ে অন্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে দেখা করেন, কথা বলেন, তখন কি অভ্যন্তরীণ বিষয় বিঘ্নিত হয়?’

তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতরা যখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে কথা বলে তখন অভ্যন্তরীণ বিষয় হয় না। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে কথা বললে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হয়ে যায়!’

 

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার