স্ত্রী হত্যায় দণ্ড প্রদানে স্বামীর উপস্থিতির প্রমাণ জরুরি

Daily Ajker Sylhet

দৈনিক আজকের সিলেট

২৪ মার্চ ২০২৩, ১০:৩৭ অপরাহ্ণ


স্ত্রী হত্যায় দণ্ড প্রদানে স্বামীর উপস্থিতির প্রমাণ জরুরি

স্টাফ রিপোর্টার:
স্ত্রী হত্যা মামলায় দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে স্বামীর উপস্থিতি প্রমাণের ওপর জোর দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, সাক্ষ্য আইনের ১০৬ ধারা অনুযায়ী ঋণাত্মক দায় নীতি (ঘটনার সময় স্বামীর উপস্থিতি) প্রযোজ্য হয় তাহলে মামলার আসামিকেই প্রমাণ করতে হবে যে সেখানে হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। আর যদি হত্যাকাণ্ড ঘটেও থাকে তাহলে সেটা যৌতুকের দাবিতে হয়নি। তবে এই ঋণাত্মক দায় নীতিমালা প্রযোজ্য হওয়ার পূর্বে দু’টি প্রাথমিক বিষয় রাষ্ট্রপক্ষকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠে প্রমাণ করতে হবে। এর একটি হলো মামলার ভিকটিম (স্ত্রী) আসামির হেফাজতে ছিল এবং ঘটনার সময় আসামি এবং ভিকটিম একত্রে ছিল।

‘রাষ্ট্র বনাম আব্দুল্লাহ ওরফে তিতুমীর’ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। রায়ে বলা হয়েছে, স্ত্রী হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষকে প্রমাণ করতে হবে যে অপরাধ সংঘটনের সময় স্বামীর হেফাজতে ছিল স্ত্রী এবং তিনিই তার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন।

২০১০ সালে যশোরের কোতয়ালি থানার সালমা খাতুনের সঙ্গে বিবাহ হয় আব্দুল্লাহ ওরফে তিতুমীর ওরফে তিতুর। দেড় বছরের সংসার জীবনের সমাপ্তি হয় ২০১২ সালের ৯ জুলাই। ওইদিন রাতে শ্বশুর বাড়ি থেকে অগ্নিদগ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয় সালমার। স্বামী তিতুমীরের বিরুদ্ধে ভিকটিমের বাবার করা মামলায় অভিযোগ করা হয়, যৌতুক হিসাবে মোটরসাইকেল না দেওয়ায় সালমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় শ্বাসরোধ করে কেরোসিন জাতীয় পদার্থ গায়ে ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ২০১৭ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(ক) ধারায় তিতুমীরকে মৃত্যুদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করে ট্রাইব্যুনাল।

এই মামলার ডেথ রেফারেন্স খারিজ ও আসামির আপিল গ্রহণ করে হাইকোর্ট রায়ে বলেছে, মামলার ভিকটিম সালমা তার স্বামী তিতুমীরের হেফাজতে ছিল এবং ঘটনার দিন ও রাতে বা ঘটনার সময় তারা একত্রে ছিল এটা রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। যেহেতু আসামির ন্যূনতম উপস্থিতি প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছেন সেহেতু এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, সাক্ষ্য আইনের ১০৬ ধারা অনুযায়ী এবং আমাদের উচ্চ আদালত কর্তৃক গৃহীত এবং বিভিন্ন সময়ে প্রণীত ঋণাত্মক দায়মূলক নির্দেশনা এই মামলার আসামির ওপর কোনভাবেই বর্তায় না।

রায়ে হাইকোর্ট বলেছে, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা বিচারিক আদালতে এলোমেলে বক্তব্য দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন ঘটনার পরপর তারা ভিকটিমের বসত ঘরে ঢুকেছেন। কেউ কেউ আবার বলেছেন ঘরের দরজা বন্ধ পেয়েছেন এবং দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছেন। সর্বোপরি তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজেই বলেছেন যে, তিনি সাক্ষীদের সহায়তায় ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছেন। এরকম একটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় প্রসিকিউশন পক্ষের দায়িত্ব ছিল বিচারিক আদালতে উপযুক্ত সাক্ষ্য বা সাক্ষী উপস্থাপন করা। যা থেকে পরিষ্কার বলা যায় যে, ভিকটিম আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরপর ভিকটিমের ঘরের দরজা বন্ধ নাকি খোলা ছিল অথবা দরজা কি ভেতর থেকে ছিটকানি দিয়ে আটকানো ছিল, নাকি কেউ দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিল। এ ধরনের উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে মামলাটি প্রমাণে শুরু থেকেই ব্যর্থ হয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষ।

রায়ে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেছেন যে ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে নরহত্যাজনিত লেখা থাকে না সেখানে পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে আদালতকে নির্ধারণ করতে হবে এটি নরহত্যাজনিত মৃত্যু কিনা। আমরা (আদালত) তার সাথে সম্পূর্ণরূপে একমত এবং আমরাও পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন অবস্থা এবং সাক্ষ্য বিবেচনায় নেওয়ার জন্য এই মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও জেরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করেছি। যেখানে আমরা কোথাও পাইনি যে, এই মৃত্যুকে কোনভাবেই নরহত্যা বলা যাবে। বরঞ্চ সুরতহাল ও ময়না তদন্ত প্রতিবেদন পরীক্ষা করলে যে কোনো সুস্থ বোধসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে দুই বা তিন ধরনের মতামত দেওয়া সম্ভব। যেখানে তিন ধরনের সম্ভাবনা উন্মুক্ত সেখানে আদালতের পক্ষে কোনভাবেই বলা সম্ভব নয় যে, এটি একটি নরহত্যাজনিত ঘটনা। এছাড়া মামলার একজন সাক্ষীও বলেননি যে, ঘটনার সময় বা ঘটনার অব্যবহিত পরে কেউ আসামিকে বসতঘর বা বসতঘরের আশপাশে দেখেছেন। ঘটনা ঘটার রাতে বা ভোরে ভিকটিম আসামির হেফাজতে ছিল। বরঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের অন্তত একজন সাক্ষী বলেছেন যে, ভিকটিম আত্মহত্যা করেছেন বলে তিনি শুনেছেন। রায়ে বিচারিক আদালতের ফাঁসির রায় বাতিল করে দণ্ডিত তিতুমীরকে খালাস দেয় হাইকোর্ট।

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার