সাবেক মন্ত্রী মান্নানের ‘নিকটজন’ ফয়ছলের লিবিয়ায় ‘মানব পাচার সাম্রাজ্য’

Daily Ajker Sylhet

দৈনিক আজকের সিলেট

০৫ ডিসে ২০২৪, ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ


সাবেক মন্ত্রী মান্নানের ‘নিকটজন’ ফয়ছলের লিবিয়ায় ‘মানব পাচার সাম্রাজ্য’

স্টাফ রিপোর্টার:
ফয়ছল মিয়া (৪৫)। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা। বাড়ি সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়ন শ্রীধরপাশা গ্রামে। গত ১৫ বছর সাবেক মন্ত্রী এমএ মান্নানের নিকটজন পরিচয় দিয়ে অনবরত ঘটিয়ে গেছেন অপরাধ কর্মকাণ্ড। তার বিরুদ্ধে রয়েছে মানবপাচারের গুরুতর অভিযোগ। ফয়ছলের এ সাম্রাজ্য বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তার কাছে টাকা দিয়ে সিলেট বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক যুবক আজ নি:স্ব। এছাড়া লিবিয়ায় অনেককে আটকে রেখে পরিবারের কাছ থেকে বার বার টাকা নেওয়ারও অনেক অভিযোগ আছে ফয়ছলের বিরুদ্ধে। এমন একটি অভিযোগে গত ২৭ নভেম্বর সিলেট মানব পাচার অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের আবেদন করেন একই গ্রামের মৃত আছদ্দর আলীর ছেলে।

মামলার এজাহারে উল্লেখ, আবুল হকের ছেলে আলী হুসেনকে লিবিয়ায় নিয়ে গিয়ে মাফিয়া চক্র দিয়ে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করে ভিডিও চিত্র ধারন করে সেই ভিডিও মা-বাবার কাছে পাঠিয়ে ফয়ছল ও তার সহযোগী মকবুল হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা। টাকা নিয়েও ফয়ছল তার লিবিয়ার এজেন্টদের কাছ থেকে আলী হোসেনকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেননি, বরং আরো ১০ লাখ টাকা দাবি করে আলী হোসেনের উপর নির্যাতন চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

অবশেষে ছেলেকে জীবিত ফিরে পেতে ২৭ নভেম্বর সিলেট মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে ফয়ছল ও মকবুলসহ মানবপাচারকারী চক্রের ১২ সদস্যের নাম উল্লেখ করে মামলার আবেদন করেন আবুল হক। আভিযোগটি আমলে নিয়ে বুধবার (৪ ডিসেম্বর) সিলেট কোতোয়ালি মডেল থানাপুলিশকে এফআইআরের নির্দেশন দেন আদাল ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. সাইফুর রহমান। পরে সেটি (সি.আর মামলা নং ৬১) কোতোয়ালি থানায় রেকর্ড হয়।

মামলার বাদী আবুল হক বলেন- ফয়ছল ও মকবুল এবং তাদের সহযোগিরা শুধু আমার ছেলেই নয়- সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৭০-৮০ জন যুবককে ইতালি নেয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিজস্ব মাফিয়া এজেন্টদের কাছে আটক রেখে ফয়ছল ও মকবুল ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা। বাধ্য হয়ে আমি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি, আমার ছেলেকে জীবিত ফেরত পেতে সংশ্লিষ্ট সকল দ্প্তরকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে জোর দাবি জানাচ্ছি।

এদিকে, বিগত ১৫ বছর মন্ত্রী এম এ মান্নানের শেল্টারে কোটিপতি বনে গেছেন এই ফয়ছল- রয়েছে এমন গুঞ্জন। নিজ গ্রাম শ্রীধরপাশা ও সিলেট মহানগরের আখালিয়া তপোবন এলাকায় গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। বিগত দিনে তার ক্ষমতার দাপটের কাছে অসহায় ছিল জগন্নাথপুরের প্রশাসনও। মামলাবাণিজ্য, জলমহাল দখল ও মানবপাচারসহ নানা ঘটনায় আলোচনায় ফয়সল।

জানা গেছে, শান্তিগঞ্জ ও দিরাই অংশের জগন্নাথপুরের শেষের ইউনিয়ন হচ্ছে কলকলিয়া। এ ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ফয়সল মিয়া। আগে ফয়সল নিজের গ্রামে ধানের ব্যবসা করতেন। ভাইয়েরা লন্ডনে থাকায় শ্রীধরপাশা গ্রামের বাড়িতে একতলা একটি বিল্ডিং ছিল। সম্পদ বলতে তেমন কিছুই ছিল না। কিন্তু সরকার ক্ষমতায় আসায় ২০০৯ সালের এমপি ও পরবর্তীতে পরিকল্পনামন্ত্রী হওয়া এমএ মান্নানের খাস লোক হিসেবে পরিচিতি পান ফয়সল মিয়া। ২০১১ ও ২০১২ সাল থেকে শুরু হয় দাপট দেখানো। চন্ডিঢর ও কচুয়ার জাওর জলমহাল নিয়ে ফয়সল শুরু করেন রাজনীতি। বিবদমান পক্ষদ্বয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও মামলার সৃষ্টি করে ৩ উপজেলার শীর্ষ এ দু’টি জলমহাল নিজের দখলে নিয়ে নেন ফয়সল মিয়া। প্রায় এক যুগ ধরে এ দু’টি জলমহালের কর্তৃত্ব ধরে রেখে কোটি কোটি হাতিয়ে নিয়েছেন ফয়সল।

স্থানীয় মৎসজীবীরা জানিয়েছেন, মন্ত্রীর লোক হওয়ার কারণে জলমহাল নিয়ে সব দ্বন্দ্ব ও মামলা নিজের দায়িত্বে নিয়ে ফয়সল কর্তৃত্ব দেখানো শুরু করেন। প্রতি বছর এ দু’টি জলমহালে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকার মাছ বিক্রি করা হয়।

গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গ্রামের তাদের বাড়ি ছিল একতলা। প্রায় ৮ বছর আগে গ্রামের বাড়ি দোতলা করেছে। বাড়ির সামনে এক মুক্তিযোদ্ধার জমিসহ প্রায় ১০০ শতাংশ ভূমি দখলে নিয়ে মাটি ভরাট করে সীমানার ভেতরে ঢুকিয়েছে। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি মামলা রয়েছে। নিজ গ্রামে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের আমেনা ডেইরি ফার্ম নামের একটি গরুর ফার্ম রয়েছে। মামলার জর্জরিত এলাকার লোকজনের পশু জোরপূর্বক এ ফার্মে এনে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এদিকে, সিলেট শহরের আখালিয়া তপোবন এলাকায় রয়েছে ফয়সলের একটি দোতলা বাড়ি। নিজ এলাকায় টাকা কামিয়ে প্রায় ৭ বছর আগে ফয়সল কয়েক কোটি টাকা মূল্যের এই বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এখন তিনি ওই বাড়িতে বসবাস করেন। এছাড়া মহানগরের নাইওরপুল পয়েন্টে তার মালিকানাধীন দু’টি দোকান রয়েছে। এ ছাড়া নামে-বেনামে আরও বহু সম্পত্তি রয়েছে।

তবে বর্তমানে তিনি আত্মগোপনে আছেন বলে জানা গেছে। অন্তরালে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি তার অপরাধ সাম্রাজ্যের।

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 992 বার