শিশু আয়ানের মৃত্যু : তদন্তে নতুন কমিটি করে দিলেন হাইকোর্ট
২০ ফেব্রু ২০২৪, ১২:৩৩ অপরাহ্ণ
স্টাফ রিপোর্টার:
রাজধানীর সাতারকুল বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খৎনার জন্য অজ্ঞান করা শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে নতুন কমিটি গঠন করে দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আদালত বলেছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিটির রিপোর্ট আমাদের মনঃপূত হয়নি। আমরা পাঁচ সদস্যের নতুন কমিটি করে দিচ্ছি।
মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
কমিটিতে তিনজন চিকিৎসক, দুইজন সিভিল সোসাইটির ব্যক্তি ও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে রাখা হয়েছে। কমিটি এক মাসের মধ্যে আয়ানের মৃত্যুর পুরো ঘটনা তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবে।
সোহওয়ার্দী হাসপাতালের অধ্যাপক ডাক্তার এ বি এম মাকসুদুল আলমকে কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে। শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকদের অবহেলা আছে কি না, তার মৃত্যুর ঘটনায় কারা দায়ী, এই কমিটি তা খুঁজে বের করবে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সেলিম আজাদ। রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম। ইউনাইটেড হাসপাতালের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা।
এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি সুন্নতে খৎনা করাতে গিয়ে রাজধানীর বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট লোক দেখানো (আইওয়াশ) ও হাস্যকর বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।
আদালত বলেন, দায় এড়ানোর জন্যই তারা (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) এ ধরনের রিপোর্ট দাখিল করেছে। শিশু আয়ানের অ্যাজমা সমস্যা থাকার কথা জানার পরও কেন চিকিৎসকরা অপারেশনের জন্য এত তাড়াহুড়া করলেন?
গত ২৮ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চে এ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, তদন্ত কমিটি বলেছে, ৫ বছর ৮ মাস বয়সী আয়ানের ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা (হাঁপানি) ছিল। এই বয়সে অটো পিক বা অ্যালার্জিক অ্যাজমা হয়ে থাকে। ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা অ্যালার্জেন (অতি সংবেদনশীলকারক) দিয়ে হয়।
অস্ত্রোপচারের আগে আয়ানকে অ্যানেস্থেসিয়া বা সংবেদনহীন করতে প্রয়োগ করা ইনজেকশন প্রোফোফল মারাত্মক অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া (অ্যানাফিল্যাকটয়েড রিয়্যাকশন) সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে শ্বাসতন্ত্র সংকুচিত হয়ে (ল্যারিঙ্গো স্পাজম) বা (ব্রঙ্কোস্পাজম) শ্বাসনালীর আশপাশের পেশি শক্ত হয়ে খিঁচুনি হয়ে থাকতে পারে। যা অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ ম্যানেজ করেছেন।
চার নম্বর মতামতে বলা হয়েছে, সিপিআর (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) ও ওষুধ (মেডিকেশন) দিয়ে আয়ানের হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনতে ১০ মিনিটের মতো সময় লেগেছিল। যার কারণে হাইপক্সিক ব্রেন ইনজুরি (মস্তিষ্কে অক্সিজেন প্রবাহ বন্ধ হয়ে মৃত্যু) হয়ে আয়ানের মৃত্যু হতে পারে। তখন সিটি স্ক্যান বা ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাম-ইসিজি করলে হাইপক্সিক ব্রেন ইনজুরি হয়েছিল কি না, তা জানা যেত। তাছাড়া সিপিআরের কারণে (রিব ফ্র্যাকচার) পাঁজরের হাড়ও ভেঙে যেতে পারে বলেও মতামতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়, সিপিআর একটি জীবনদায়ী পদ্ধতি। মানুষের হৃদযন্ত্র ও শ্বাসযন্ত্রের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে দুই হাতে বুকে চাপ দিয়ে শরীরে রক্ত ও অক্সিজেন চলাচল স্বাভাবিক করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আয়ান চাইল্ডহুড অ্যাজমা সমস্যায় ভুগছিল। শ্বাসকষ্টের জন্য আয়ানকে মাঝে মাঝে নেবুলাইজার ও ইনহেলার দেওয়া লাগতো। সুন্নতে খৎনার অপারেশনের আগে ওয়েটিং রুমে তাকে নেবুলাইজার ও ইনহেলার দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়টি চিকিৎসকদের জানানো হয়নি।
প্রতিবেদনের মতামত অংশে আরও বলা হয়, শিশু আয়ানের অপারেশনের সময় স্বাভাবিক রক্তপাত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
চার দফা সুপারিশ
সুন্নতে খৎনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ানের মতো আর কারো যেন মৃত্যু না হয়, এজন্য চার দফা সুপারিশ করেছে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি।
১. হাসপাতালে একাধিক অ্যানেসথেসিওলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া।
২. রোগী ও রোগীর আত্মীয়-স্বজনকে অ্যানেসথেসিয়া ও অপারেশনের ঝুঁকিগুলো ভালোভাবে অবহিত করা।
৩. হাসপাতালে আইসিইউ ব্যবস্থা রাখা।
৪. সরকারের অনুমোদনের পর হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করা।
গত ৯ জানুয়ারি শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম। পরে শিশু আয়ানের বাবা রিটে পক্ষভুক্ত হন। নতুন করে রিটে ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের রিটে বিবাদী করা হয়।
গত ৮ জানুয়ারি রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যায় শিশু আয়ান। এর আগে তাকে বাড্ডার সাতারকুলের ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নাতে খৎনা করানোর জন্য নেওয়া হয়েছিল। সেখানে অজ্ঞান করার পর তার আর জ্ঞান ফেরেনি। এরপর সেখান থেকে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসিইউতে আনা হয়। এখানে সাত দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর মারা যায় সে।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 984 বার