বাবুল-ইলিয়াসের বিরুদ্ধে মামলা : যেভাবে এগোচ্ছে তদন্ত
২৫ জানু ২০২৩, ১২:৩৭ অপরাহ্ণ
স্টাফ রিপোর্টার:
সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার ও প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে দায়ের হওয়া দুই মামলার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। তদন্তে উদ্ধার করা যায়নি মামলার গুরুত্বপূর্ণ কোনো আলামতও। এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আসেনি কোনো আসামি। শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি থানার মামলায় একবার রিমান্ডে আনা হয়েছিল বাবুল আক্তারকে। তাতেও মেলেনি গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য। আবার চট্টগ্রাম নগরের খুলশী থানার মামলায় আবেদন করে রিমান্ড পাননি তদন্ত কর্মকর্তা।
অগ্রগতি বলতে শুধুমাত্র ইউটিউব থেকে কয়েকটি লিংক শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তারা। এসব লিংক যাচাই-বাছাই করছেন তারা। এছাড়া ভিডিওর ফুটেজ কীভাবে বিদেশে গেল সেটি তদন্ত করা হচ্ছে। কবে নাগাদ মামলা দুটির তদন্ত শেষ হতে পারে সেই প্রশ্নের উত্তরও নেই তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে। যদিও মামলা দুটি যথাসময়ে শেষ হওয়া এবং সুষ্ঠু তদন্তের বিষয়ে আশাবাদী বাদীপক্ষ।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েকটি প্রশ্নকে সামনে রেখে এগোচ্ছে মামলা দুটির তদন্ত প্রক্রিয়া। এর মধ্যে রয়েছে বাবুল আক্তার কারাগারে থাকা অবস্থায় কীভাবে বাদী ও পিবিআইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা-বিভ্রান্তিকর তথ্য উপাত্ত যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সাংবাদিক ইলিয়াসের কাছে গেছে? এতে কারা কারা জড়িত তা শনাক্ত করা? জব্দ করা ভিডিও ক্লিপে বাবুল আক্তারের ভয়েস রেকর্ড তিনি নিজেই সরবরাহ করছেন, নাকি এটি সুপার এডিট করে আসামিদের যোগসাজশে ইলিয়াসের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে? এছাড়া ফেসবুক এবং ইউটিউব লিংকগুলো ব্যবহার করে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার, মন্তব্য, লাইক ও শেয়ারকারীদের সঙ্গে আসামিদের কোনো যোগসাজশ আছে কি না, এসব প্রশ্ন সামনে রাখা হচ্ছে।
আদালত সূত্র জানায়, স্ত্রী হত্যায় দায়ের হওয়া মামলায় কারাগারে আছেন বাবুল আক্তার। তাকে চট্টগ্রাম নগরের খুলশী ও রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি থানায় দায়ের হওয়া দুটি মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এছাড়া মামলার আসামি হওয়া ইলিয়াস হোসাইন আদালতের কাগজে-কলমে পলাতক রয়েছেন। তবে গ্রেপ্তার হওয়া ছাড়াই আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন বাবুল আক্তারের বাবা মো. আব্দুল ওয়াদুদ মিয়া ও ভাই মো. হাবিবুর রহমান লাবু।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যা মামলায় মিথ্যা ও অসত্য তথ্য সরবরাহ করা এবং তা প্রচারের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে বাবুল আক্তার ও ইলিয়াস হোসেনসহ চার জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার বাকি দুই আসামি হলেন বাবুল আক্তারের ভাই হাবিবুর রহমান লাবু ও বাবা আব্দুল ওয়াদুদ মিয়া। রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় আলোচিত মামলাটি দায়ের করেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার। মামলাটি তদন্ত করছেন ধানমন্ডি থানা পরিদর্শক (অপারেশন) রবিউল ইসলাম।
প্রায় একই অভিযোগে এবং একই আসামিদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরের খুলশী থানায় পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। একই বছরের ১৭ অক্টোবর পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) নাইমা সুলতানা বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছিলেন। এটি তদন্ত করছে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ উত্তর জোনের পরিদর্শক আরিফুর রহমান।
দুটি মামলার অভিযোগে বলা হয়- দেশের চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যা মামলা তদন্তাধীন থাকার সময়ে প্রধান আসামি সাবেক এসপি বাবুল আক্তারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট পিবিআই। তিনি কারাগারে থাকা অবস্থায় ভাই মো. হাবিবুর রহমান লাবু ও বাবা আবদুল ওয়াদুদ মিয়াসহ অজ্ঞাতপরিচয় আসামিরা মিলে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ইলিয়াস হোসাইনকে দিয়ে বিভিন্ন অপকৌশল এবং ষড়যন্ত্র করে। মিতু হত্যার মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে এবং পুলিশ-পিবিআইয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য আসামিরা এসব ষড়যন্ত্র করেন।
তারই অংশ হিসেবে ইলিয়াস হোসাইন তার ফেসবুক আইডি ও ইউটিউব চ্যানেল ব্যবহার করে দুটি ভিডিও আপলোড করেন। যার একটির শিরোনাম ‘স্ত্রী খুন, স্বামী জেলে, খুনি পেয়েছেন তদন্তের দায়িত্ব’ এবং অপরটির শিরোনাম ‘প্রতিবছর স্বামী পাল্টায় পিবিআইয়ের এসপি নাইমা’। এসব ভিডিও আপলোডের পর অজ্ঞাতপরিচয় আসামিরা বিরূপ মন্তব্য, লাইক ও শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে দুই বাদীর মানহানি ও পিবিআইয়ের মতো বিশেষায়িত তদন্ত সংস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
ধানমন্ডি থানায় দায়ের করা মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা ও একই থানার ইন্সপেক্টর (অপারেশন) রবিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাবুল আক্তারকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এটা ডিজিটাল আইনের মামলা। আমরা বিভিন্ন ভয়েস রেকর্ড যাচাই-বাছাই করে দেখছি। ইলিয়াসের আইডি থেকে যে লিংকগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এর বেশি আপাতত আগ্রগতি নেই।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর এসপি নাইমা সুলতানা বাদী হয়ে দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম নগর ডিবি উত্তর জোনের পরিদর্শক আরিফুর রহমান বলেন, মামলায় আমরা বিভিন্ন ডিজিটাল আলামত পরীক্ষার আবেদন করেছি। আসামি ইলিয়াসের আপলোড করা ভিডিও যাচাই করে দেখা হচ্ছে। আসামিদের মধ্যে দুজন জামিনে, একজন কারাগারে এবং আরেকজন দেশের বাইরে আছে। ওনাদের কাছ থেকে আসলে বস্তুসাক্ষ্য পাওয়ার মতো অবস্থা নেই। তারপরও আমরা তদন্ত করে দেখব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান এবং অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার বলেন, দুটি মামলাই তদন্তাধীন আছে। একটি ধানমন্ডি থানা পুলিশ আরেকটি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিট তদন্ত করছে। তারা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমরা তো তদন্তাধীন বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারি না। আবার যেহেতু আমরা নিজেরা বাদী সেহেতু পিবিআই এ মামলা তদন্ত করবে না। এটি নৈতিকভাবে ঠিকও না।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে তৎকালীন পুলিশ সুপার ও মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
তবে মামলাটিতে স্ত্রী হত্যাকাণ্ডে স্বামী বাবুল আক্তারেরই সম্পৃক্ততা পায় পিবিআই। ২০২১ সালের ১২ মে আগের মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। একই দিন বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানায় দ্বিতীয় মামলাটি দায়ের করেন মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন। ওইদিনই মামলাটিতে বাবুল আক্তারকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পিবিআই। সেই থেকে কারাগারে রয়েছেন বাবুল।
এদিকে, প্রথম মামলায় পিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর নারাজির আবেদন করেন বাবুলের আইনজীবী। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৩ নভেম্বর নারাজি ও পিবিআইয়ের প্রতিবেদন খারিজ করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। এরপর দুটি মামলাই তদন্ত করতে থাকে পিবিআই। তবে পরবর্তী সময়ে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গত বছরের ২৫ জানুয়ারি মিতুর বাবার দায়ের করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এরপর একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম মামলাটি অধিকতর তদন্ত শেষে বাবুলসহ ৭ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার