ফুল ও মাটির গল্প
০৫ জানু ২০২৩, ০৭:৫৯ পূর্বাহ্ণ
মিন্টু রায়:
—বিজয় দিবসে সব দোকানেই কি ফ্রি দেবে?
—না, তা হবে কেন?
—তাহলে উনি দিচ্ছেন যে?
—হ্যাঁ, উনি প্রতিবছর এই দিনটায় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে বিনা মূল্যে ফুল দেন। যুদ্ধের সময় এখানকার কয়েকটি গ্রাম পোড়ানো হয়েছিল। বনবাড়ি গ্রামের ঐ ফাঁকা ভিটায় অনেক মানুষকে মেরেছিল। স্থানীয় বধ্যভূমি ওটা। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ওখানে ফুল দেয়া হয়।
—উনি কি খুব বড়লোক, বাবা? নাকি ওনার নাম ‘বিজয়’ সে কারণে?
—কেন? এমন প্রশ্ন করছ কেন?
—না। মানে, উনি এত্তগুলো ফুল সম্পূর্ণ ফ্রিতে দিচ্ছেন! তাহলে কি ওনার ফুলের বাগান আছে?
—হ্যাঁ বাবা, উনি অনেক বড় লোক। ওনার ভিতরে বিশাল একটা মন আছে। সে মনে হাজার রঙের ফুলের বাগান আছে। হরেক রকম ফুল সেখানে প্রতিনিয়ত ফুটছে।
—ওনার চোখে আজ জল কেন? উনি কি কাঁদছেন?
—সে এক বিরাট গল্প!
—কী সেই গল্পটা?
—তোমার কাছে আজ গল্প মনে হবে। কিন্তু এটাই আমাদের স্বাধীনতার প্রতিরূপ। তুমি যেমন আমার থেকে আজ গল্প শুনছ; যেমন করে আমার হাত ধরে হেঁটে চলছ। এমনি করে বাবার আঙুল ধরে হাঁটার কিংবা বাবার কাছে গল্প শোনার সুযোগ তোমার ঐ বিজয় কাকার ভাগ্যে জোটেনি।
—কেন বাবা?
—সে অনেক বড় কাহিনি।
—আমি শুনতে চাই বাবা।
—তবে শোনো। এই যে এখন তুমি যে-পথ দিয়ে আমার আঙুল ধরে হেঁটে চলছ এই পথটি তাঁর রক্তে কেনা।
—বুঝলাম না বাবা।
—বুঝিয়ে বলছি। আসলে আমাদের এই দেশ একসময় পাকিস্তানের অংশ ছিল।
—বাব্বা! পাকিস্তান? সে তো অনেক দূর! আমি মানচিত্রে দেখেছি।
—হ্যাঁ, তাই তো। দূর তাতে কী হবে? সমস্ত শাসনক্ষমতা সেই দূরের মানুষের হাতে ছিল। তাতে কী হয়েছিল জানো?
—কী হয়েছিল?
—তারা আমাদের এই অংশের মানুষদের মানুষই মনে করত না। শাসনের নামে তারা শোষণ করত। তখন একজন মহান নেতা আমাদের স্বপ্ন দেখান স্বাধীনতার। তিনি একদিন বিশাল বড় জনসভায় বলেন—এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম…। তার কিছুদিন পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সে সময়ে তোমার ঐ বিজয় কাকার বাবা গিরিধরও ট্রেনিংয়ে যান। তিনি তার মাত্র কয়েকমাস আগে বিয়ে করেছিলেন। সেই নতুন বউকে রেখে যুদ্ধের ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলেন।
—বিজয় কাকার মা তখন বাধা দেননি?
—না, তা দেননি। কারণ, তাঁদের সন্তানের জন্য একটা স্বাধীন দেশের খুব প্রয়োজন ছিল যে!
—বিজয় কাকা তখন কতটুকু, বাবা?
—তোমার বিজয় কাকার তখন জন্মই হয়নি। মায়ের পেটে।
—তারপর কী হলো, বলো…!
—তারপর, তোমার বিজয় কাকা জন্মানোর কিছুদিন আগে উনি একবার বাড়িতে এলেন। তখন পুরোদমে যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানিরা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষ মারছে। সকালবেলা লোকমুখে শোনা গেল আজ বহু গ্রাম-মঠবাড়িতে আগুন দেবে। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। পরে দেখা গেল এগারোটা নাগাদ পাশের গ্রাম খোরট-এ আগুনে জ্বলছে। প্রাণ রক্ষায় মানুষ দিগ্বিদিক ছুটছে। উপায়হীন গিরিধর তাঁর স্ত্রীকে কাঁধে নিয়ে বনবাড়ি বিলের দিকে পালালেন।
—আচ্ছা বাবা, ওনাকে কাঁধে নিলেন কেন?
—তোমার বিজয় কাকা পেটে ছিলেন তো! দ্রুত হাঁটতে পারছিলেন না, তাই।
—ওনার কি খুব কষ্ট হচ্ছিল, বাবা?
—কষ্ট একটু হয়েছিল হয়তো। তবে তার চেয়ে বড় কষ্ট হয়েছিল কি জানো?
—কী, বাবা?
—গিরিধর অনাথ ছিলেন। মামাবাড়িতে বড় হয়েছেন। বিয়ে করে বাড়িতে এলে স্বামী-স্ত্রী মিলে খর-বাঁশ দিয়ে একখানা ঘর তৈরি করেছিলেন। সেই ঘরের আগুন গিরিধর স্পষ্ট দেখেছিলেন। মনে হচ্ছিল ঘরে নয়; সে আগুন তার বুকের ওপর দাউদাউ করে জ্বলছে। তখন হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। সহ্য করতে না পেরে একখানা দা হাতে ছুটলেন। মিলিটারিরা তখন অন্যপাশে আগুন দিচ্ছিল। একজন মিলিটারির জুতার লেস খুলে গিয়েছিল। উবু হয়ে সেটা বাঁধছিল। গিরিধর পিছন থেকে এসে এককোপে মাথাটাকে আলাদা করে ফেলেছিলেন। রাজাকার হাবু মোল্লা হঠাত্ তাকিয়ে এ দৃশ্য দেখে চিত্কার দেয়। মিলিটারিটার বন্দুকটা গিরিধর নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু ট্রিগার চাপলেও গুলি বেরুচ্ছিল না! সে সুযোগে একজন বেয়োনেট দিয়ে গিরিধরকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়।
তার কিছুদিন পরেই এই বিজয়ের জন্ম হয়। একদিন বিজয়ের মা বিজয়কে বাপের সমাধির পাশে শুইয়ে দিয়ে একগুচ্ছ ফুল রেখে সম্মান জানান। হ্যাঁ, সেদিনই পাকিস্তানিরা
মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। শুনে অবাক হবে—এই দিনের আগে তার মা কখনো বিজয়কে মাটি স্পর্শ করাননি। সেই উদ্দেশ্যে বিজয় প্রতিবছরই ফুল দিয়ে দেশ ও তার সূর্যসন্তানদের এভাবে সম্মান জানিয়েই চলছেন।
—দ্যাখো বাবা, বিজয় কাকু ফুল দিচ্ছেন, তার মুখে হাসি কিন্তু চোখে জল।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1.1K বার