নেতৃত্ব-শূন্যতায় ভূগছে সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গন!

Daily Ajker Sylhet

দৈনিক আজকের সিলেট

২৯ জানু ২০২৩, ০৭:১২ অপরাহ্ণ


নেতৃত্ব-শূন্যতায় ভূগছে সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গন!

স্টাফ রিপোর্টার :
সরকারে ছিলেন না। অসুস্থতার কারণে রাজনীতি থেকেও অঘোষিত অবসরে ছিলেন। তারপরও গত বৎসর এপ্রিলের শেষ রাত পর্যন্ত সিলেটের রাজনীতির অভিভাবক হয়ে ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। ১লা মে রাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান সাবেক এই অর্থমন্ত্রী।

টানা ১২ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। সংসদে রেকর্ড ১২টি বাজেট পেশ করেছেন। ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য। তবে সবকিছু ছাপিয়ে মুহিত ছিলেন, সিলেটের রাজনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অভিভাবক।
আব্দুস সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, বরুণ রায়, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, এম সাইফুর রহমান, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও বদরউদ্দিন আহমদ কামরান এবং আব্দুল খালিক মায়নের মৃত্যুতে সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব শূন্যতা কেবলই বাড়ছিল। আবুল মাল আবদুল মুহিতের মৃত্যুতে তা আরও তীব্র হলো।

 


বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি না হওয়ায় এই সংকট তীব্র হয়েছে বলে মনে করেন রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বর্তমানে সাবেক সফল শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জেবুন নেছা হক, কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী ছাড়া দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নীতিনির্ধারণী কমিটিতে সিলেটের কোনো নেতা নেই। তবে নাহিদকে ঘিরে রাজনৈতিক কর্মকান্ড নেতাকর্মীদের সক্রিয় হচ্ছেন ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুল মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, এখানকার নেতারা দলীয় বৃত্তের মধ্যে বন্দি। এমনকি দলের মধ্যেও সবার কাছে তারা গ্রহণযোগ্য নন। দলের ভেতরের গ্রুপ-উপগ্রুপের নেতা তারা। ফলে দল ছাপিয়ে জাতীয় নেতা, সব মানুষের নেতা হয়ে উঠতে পারছে না কেউ।
বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি না হওয়ার জন্য প্রয়াত নেতারা অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘এসব নেতা তাদের বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করে যাননি। হয়তো তারা মনে করেছেন, বিকল্প তৈরি করলে প্রতিদ্বন্ধী বেড়ে যাবে।’
ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া এবং দলের ভেতরে নেতৃত্বের চর্চা না থাকাকেও নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দেয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি।
মুহিতের আগে সিলেটের জাতীয় নেতাদের মধ্যে সবশেষ মারা যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে মারা যান সাবেক রেলমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সুরঞ্জিত। সিলেট অঞ্চলের এক কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ ছিলেন তিনি। তারপর মারাযান সাবেক অর্থ মন্ত্রী আবুল মাল আবুল মুহিত।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সিলেটের নেতাদের মধ্যে আব্দুস সামাদ আজাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্পিকার, শাহ এ এম এস কিবরিয়া অর্থমন্ত্রী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পান।
বর্তমান মন্ত্রিসভায় সিলেটের পাঁচ প্রতিনিধি রয়েছেন। তারা হলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন এবং বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। তবে মন্ত্রিসভায় থাকলেও জাতীয় বা স্থানীয় রাজনীতিতে তারা কেউই সামনের সারির নন।
আব্দুস সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে ছিলেন। এদের মধ্যে দেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি মনে করা হতো তাকে। আর নিজ এলাকায় তো ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য। এখন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলি সদস্য রয়েছেন কেবল নুরুল ইসলাম নাহিদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য জেবুন নেছা হক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী ।
বিএনপির সবশেষ শাসনামলে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন এম সাইফুর রহমান। তিনিও সংসদে রেকর্ড ১২টি বাজেট পেশ করেন। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন তিনি।সিলেটে ব্যাপক উন্নয়নের জন্য সাইফুর রহমান সব দলের কাছেই ছিলেন গ্রহণযোগ্য ব্যাক্তি। তখন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন সিলেটের আরেক নেতা হারিছ চৌধুরী। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর আত্মগোপনে যান হারিছ চৌধুরী। গত ১১ জানুয়ারি মারা যান তিনি। সাইফুর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপির শীর্ষ নীতিনির্ধারণী ফোরামে ঠাঁই হয়নি সিলেটের কোনো নেতার।
এখন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে আছেন সিলেটের খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ও তাহসীনা রুশদীর লুনা।
কেবল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নয়, সিলেটের বাম রাজনীতিতেও রয়েছে নেতৃত্বের সংকট। একসময় বরুণ রায়, পীর হাবিবুর রহমান, আব্দুল হামিদের মতো নেতারা পুরো দেশের বাম রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিপ্লবী বরুণ রায়ের মৃত্যুর পর এই ধারায়ও দেখা দেয় শূন্যতা।

সিলেটের অন্য জাতীয় নেতাদের মধ্যে ২০০১ সালের ১০ জুলাই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল আব্দুস সামাদ আজাদ, ২০১০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী মারা যান।
দলের নীতিনির্ধারণী পদে না থাকলেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও দলীয় প্রধানের শ্রদ্ধাস্পদ হিসেবে আওয়ামী রাজনীতিতে প্রভাবশালী ছিলেন তারা তিনজনই। ছিলেন সিলেটের সামাজিক অঙ্গনেরও অভিভাবক।
আর ২০০৪ সালে হবিগঞ্জে নিজ এলাকায় গ্রেনেড হামলায় নিহত হন শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নিহত হন এম সাইফুর রহমান।
সিলেটের বাসিন্দা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন মনে করেন, তরুণদেরই এই শূন্যতা পূরণ করতে হবে। প্রয়াত জাতীয় নেতাদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে।
বর্তমানে গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্বে আছেন সিলেটের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্যারিস্টার আরশ আলী। তিনি বলেন, ‘আগে যারা রাজনীতি করতেন তারা অনেক পড়াশোনা করতেন। রাজনীতি, সমাজনীতি, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের অনেক জানাশোনা ছিল। এখন যারা রাজনীতি করছেন তাদের মধ্যে পড়াশোনার বড়ই অভাব।
আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘কোনো কিছু তো শূন্য থাকবে না। এই শূন্যতাও পূরণ হবে। আশা করছি, ভালো কিছু দিয়েই পূরণ হবে।’
কেবল এই ক’জনই নন, এক/এগারো বিতর্কে রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে ছিটকে পড়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মুহাম্মদ মনসুর। নানা বিতর্ক সত্তেও আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজের অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী। তিনিও নিঁখোজ রয়েছেন ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে।

 

সিলেটের জনপ্রিয় নেতা সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য বদরউদ্দিন আহমদ কামরান মারা যান ২০২০ সালের ১৫ জুন। আর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে রাজনীতি থেকে দূরে রয়েছেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। তাদের অনুপস্থিতিও শূন্যতা সৃষ্টি করেছে সিলেটের রাজনৈতিক নেতৃত্বে।


সিলেট থেকে উঠে আসা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেল চৌধুরী বলেন, ‘জাতীয় নেতাদের মধ্যে সবশেষ আবুল মাল আবদুল মুহিতের মৃত্যু সিলেটের রাজনীতিতে একটি বড় শূন্যতার সৃষ্টি করল। সহজে এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।’
বর্তমান নেতারা কেন এই অভাব পূরণ করতে পারছেন না- এমন পৃশ্নে নাদেল বলেন, ‘তাদের যে যোগ্যতা, পড়াশোনা, নেতৃত্বগুণ ও পৃভাব ছিল তা বর্তমান নেতাদের মধ্যে অনুপস্থিত। রাতারাতি এটা গড়ে উঠবেও না।’
নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য রাজনীতির স্বাভাবিক পরিবেশ প্রয়োজন উল্লেখ করে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবন বলেন, ‘বর্তমানে তো দেশে রাজনীতিই নেই। নেতৃত্ব তৈরি হবে কী করে?’

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1.1K বার