টিকেট সংকট-মূল্য বৃদ্ধি, বিপাকে আমেরিকা প্রবাসীরা
০৭ মে ২০২৪, ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ
স্টাফ রিপোর্টার:
নিউইয়র্ক-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ হয়ে বাংলাদেশে চলাচলকারী ফ্লাইটগুলোর টিকিটের দাম বাড়িয়েছে প্রায় সব এয়ারলাইনস। বৃদ্ধির পরিমাণ ৩০% থেকে ৩৫% পর্যন্ত। একদিকে টিকিটের মূল্যবৃদ্ধি এবং অপরদিকে ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ায় আমেরিকায় থাকা বাংলাদেশি- বিশেষ সিলেটের প্রবাসীরা নিদারুণ সংকটে পড়েছেন।
বিশেষ করে আসছে গ্রীষ্মে এবং ঈদুল আজহা উপলক্ষে যারা দেশে এসে স্বজনের সান্নিধ্যে কোরবানির ঈদের খুশি শেয়ারের কথা ভাবছেন- টিকিটের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেওয়ায় তারা গভীর হতাশ হয়ে পড়েছেন।
আর প্রবাসীরা ঈদের সময় দেশে আসা কমিয়ে দিলে ট্র্যাভেল ব্যবসায়ীরাও ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে তাদের শঙ্কা।
যুক্তরাষ্ট্রে ট্র্যাভেল এজেন্টদের সমন্বয়ে গঠিত ‘আমেরিকান ট্র্যাভেল এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ তথা আটাব’র প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সেলিম হারুন (কর্ণফুলী ট্র্যাভেল) উদ্ভুত পরিস্থিতির আলোকে জানান, নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় যাতায়াতকারী প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সাম্প্রতিক সময়ে আমিরাত, কাতার, কুয়েতের ফ্লাইট কমানো হয়েছে। এর ফলে প্যাসেঞ্জারকে টিকিট প্রদানে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নানাভাবে চেষ্টার পর টিকিট পাওয়া গেলেও গত বছরের এ সময়ের চেয়ে তার দাম ৩০% এর অধিক ধার্য করা হয়েছে। টার্কিশ এয়ারলাইনস ফ্লাইট না কমালেও টিকিটের মূল্য সমানতালে বাড়িয়েছে। সেলিম হারুন উল্লেখ করেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্য এবং বাড়ি ভাড়া বেড়েই চলছে। তার সঙ্গে সংগতি রেখে প্রবাসীদের আয়ের পরিধি বাড়েনি। অধিকন্তু অনেকের কর্মঘণ্টা হ্রাস পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আটাবের সদস্য এবং ডিজিটাল ট্র্যাভেল এস্টোরিয়ার সিইও নজরুল ইসলাম বলেন, গ্রীষ্মের ছুটির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এবার অনেকেই দেশে এসে ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। কিন্তু সেই প্রস্তুতিতে হতাশার ছাপ বিস্তৃত হচ্ছে টিকিট-সংকট এবং টিকিটের মূল্য বৃদ্ধিতে। ৪-৫ সদস্যের পরিবারের রাউন্ড টিপ টিকিটেই লাগছে ৮ থেকে ৯ হাজার ডলার করে। সঙ্গে রয়েছে আনুষঙ্গিক খরচ এবং স্বজনের জন্য উপঢৌকন। অর্থাৎ অল্প এবং মাঝারি আয়ের একেক পরিবারের প্রয়োজন কমপক্ষে ২০ হাজার ডলার। এ অবস্থায় মাথায় বাজ পড়ার অবস্থা।
নজরুল ইসলাম আরও বলেন, গত বছর জুন-জুলাইয়ে রাউন্ড টিপ টিকিটের মূল্য ছিল গড়-পড়তা ১৪০০ ডলার করে (আগে ক্রয় করলে)। এবার ২০০০ ডলারের নিচে পাওয়াই যাচ্ছে না।
টেক্সাসের ডালাসভিত্তিক ট্যাভেল এজেন্সি ‘এ-ওয়ান ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুরস’র প্রেসিডেন্ট শাহীন হাসান এয়ারলাইনসের টিকিটের হরিবল অবস্থায় হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, প্রতি বছরই গ্রীষ্মের ছুটির সময়ে এয়ারলাইনসগুলো টিকিটের দাম বাড়ায়। এবার সেই ছুটির সঙ্গে অনেকেই ঈদ উদযাপনকে যোগ করার সংবাদটি এয়ারলাইনসের জন্য পোয়াবারো হয়েছে। তারাও দাম বাড়িয়েছে। আমরা নানা পথ ঘুরে কিছুটা কম দামে টিকিটের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হলেও সন্তানাদি নিয়ে অনেকেই সে ধকল পোহাতে রাজি নন।
২৫ বছর যাবৎ এয়ারলাইনসের টিকিট বিক্রির মাধ্যমে আমেরিকার বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বিশেষভাবে পরিচিত ব্যবসায়ী শাহীন হাসান বলেন, এয়ারলাইনসগুলো তার ফ্লাইট কমিয়েছে, তবে গত বছরের তুলনায় খুব বেশি কমায়নি।
আটাব প্রেসিডেন্ট সেলিম হারুন এবং সিনিয়র সদস্য নজরুল ইসলাম জানালেন, বাংলাদেশে টিকিট বিক্রির মুনাফা বিভিন্ন ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনসাপেক্ষে বিদেশে পাঠানো হয়। এটা প্রতি মাসে পাঠানোর কথা। কিন্তু গেল কয়েকবছর ধরে নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন না পাওয়ায় এজেন্সিগুলো সঠিক সময়ে অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। যার ফলে বিপুল পরিমাণের বকেয়া জমেছে। এর পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। আর এ কারণেই ঢাকায় অবতরণকারী ফ্লাইটসমূহের ব্যাপারে এয়ারলাইন্সগুলোর আগ্রহে অনেকটা ভাটা পড়েছে। ফ্লাইটের সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি আর্থিক লোকসান পুষিয়ে নিতে টিকিটের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ ডলার সংকটের দায় বর্তেছে কঠোর পরিশ্রমী প্রবাসীদের উপর। এটা সত্যি দুঃখজনক একটি ব্যাপার।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কোরবানির ঈদ উপলক্ষে ৫০ হাজারের অধিক প্রবাসী বাংলাদেশে আসার কথা। সে অনুযায়ী টিকিটের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে নিপতিত হয়েছেন তারা।
জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন এয়ারলাইন্স কোম্পানির সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশে আটকে থাকার কথা জানিয়ে অবিলম্বে তা পরিশোধ করার তাগিদ দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ)। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে রাখার ফলে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল চুক্তি লঙ্ঘন হচ্ছে বলেও সতর্ক করেছ সংস্থাটি। আইএটিএ-এর এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সহসভাপতি ফিলিপ গোহ গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইজারা চুক্তি, খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয়, ওভারফ্লাইট ফি এবং জ্বালানির মূল্য পরিশোধের জন্য এয়ারলাইন্সগুলোর আয়ের এই অর্থ সময়মতো নিজের দেশে নিতে পারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাওনা পরিশোধে বিলম্ব হলে তাতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে লিখিত আন্তর্জাতিক হয় বাধ্যবাধকতার লঙ্ঘন এবং এয়ারলাইনসগুলোর জন্য বিনিময় হারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থা আইএটিএ বিশ্বের ৩০০টি এয়ারলাইন্স নিয়ে গঠিত একটি বাণিজ্যিক সংস্থা। এই সংস্থার অন্তর্ভুক্ত ৩০০টি এয়ারলাইন্স বিশ্বের প্রায় ৮৪ শতাংশ আকাশপথের যাত্রী পরিবহন করে। সদস্য দেশ এবং এয়ারলাইন্সগুলোর বিমান চলাচল সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়তা এবং নীতিমালা ও মান নিয়ন্ত্রণে কাজ করে আইএটিএ।
এক বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কাছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর পাওনা ৭২০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশের কাছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর পাওনা ৩২৩ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। আর পাকিস্তানের কাছে পাওনা ৩৯৯ মিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা।
বিবৃতিতে আইএটিএ বলেছে, এই বিপুল পরিমাণ দেনা পরিশোধ না করায় পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠেছে।
আইএটিএ আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং চুক্তির বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলার জন্য দুই দেশের সরকারকে অনুরোধ করেছে, যাতে এয়ারলাইনগুলো তাদের সেবা চালু রাখতে পারে।
কীভাবে এই বিপুল দায় তৈরি হলো এবং টাকা বকেয়া থাকার কী প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়তে পারে জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এবং বিমান পরিচালনা বোর্ডের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘বিদেশি যেসব এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করে, তাদের টিকিট বিক্রির মুনাফা বিভিন্ন ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনসাপেক্ষে বিদেশে পাঠানো হয়। এটা প্রতি মাসে পাঠানোর কথা। কিন্তু গেল কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন না পাওয়ায় এজেন্সিগুলো সঠিক সময়ে অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। যার ফলে বিপুল এই দেনা।’
তিনি বলেন, এর প্রভাবে এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশে তাদের টিকিটের দাম বাড়িয়েছে।
অনেকের অভিযোগ- অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে টিকিটের দাম বেশি। মূলত ক্ষতি পোষাণোর জন্য এয়ারলাইন্সগুলো টিকিটের দাম বাড়াচ্ছে, যাতে ডলারের মূল্য উঠা-নামার সঙ্গে তাদের পাওনা অর্থের সামঞ্জস্য থাকে।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 990 বার