খন্দকার মোশতাক আহমেদ: শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় এসে ৮৩ দিনের শাসনামলে যা যা করেছিলেন
০৫ জানু ২০২৩, ০১:২৩ অপরাহ্ণ
সায়েদুল ইসলাম:
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ই অগাস্টের ভোরে সপরিবারে হত্যার পর ওই দিনই রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব নেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী।
রাষ্ট্রপতি হিসাবে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র ৮৩ দিন। তেসরা নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থানে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ মুজিব সরকারের অনেক কিছু পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ”আসলে তাকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল, খুনীচক্র তাকে বসিয়েছিল। আমার মনে হয়, তিনি অনেকটা শিখণ্ডির মতোই ছিলেন। তারপরেও যেহেতু তার নেতৃত্বে সরকারটি হয়েছিল এবং সরকারের সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের, তারা ১৫ই অগাস্টের আগের ও পরের অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছিলেন।”
মি. আহমেদ উদাহরণ হিসাবে বলেন, ”১৫ই অগাস্টের আগ পর্যন্ত বাকশাল ব্যবস্থা ছিল। একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে বাকশালের একদলীয় ব্যবস্থা রদ করেন। দ্বিতীয়ত, অনেকগুলো পত্রিকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো খোলা শুরু করেন। তৃতীয়ত, ব্যক্তি পুঁজির একটি সিলিং (উর্দ্ধসীমা) ছিল তিন কোটি টাকা পর্যন্ত, সেটা তিনি ১০ কোটি টাকা করেন এবং প্রাইভেটাজাইশনে একটা গতি আনার চেষ্টা করেন।”
”তিনি একটা সাম্প্রদায়িক আবহ, যেটা একাত্তরের পর থেকে মোটামুটি ধামাচাপা পড়ে ছিল আমি বলবো, তিনি সেটা আরও উস্কে দেন। সবচাইচে বড় কথা হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্পর্কে তার প্রশ্রয়ে একটা নেতিবাচক প্রচারণা চলতে থাকে।”
এই গবেষক বলছেন, ”ওই তিরাশি দিন যদি আরও দীর্ঘায়িত হতো, তাহলে তিনি হয়তো আরও অনেক কিছু করতেন। তবে তিনি যেই সরকারের অংশ ছিলেন ১৫ই অগাস্টের আগ পর্যন্ত, ঠিক তার অনেকটাই বিপরীতধর্মী কাজ তিনি ওই সময়ে করেছেন।”
ক্ষমতা নিয়েই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা
১৫ই অগাস্ট যখন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের রক্তের দাগও শুকোয়নি, তখন নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের তিনি ‘জাতির সূর্য সন্তান’ বলে আখ্যা দেন।
মেজর জেনারেল (অবঃ) মইনুল হোসেন চৌধুরী তাঁর ‘এক জেনারেলে নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতা প্রথম দশক’ বইতে লিখেছেন, ”শেখ মুজিবের হত্যার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন। সরকার গঠন করে তিনি ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির স্থলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি প্রচলন করেন। বাংলাদেশ বিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী কিছু ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে বহাল করেন। এ সময় স্বাধীনতা বিরোধী চক্র রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে বেশ তৎপর হয়ে উঠলো।”
নতুন সরকারকে সবার আগে স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান।
১৯৭৫ সালের ২০শে আগস্ট খন্দকার মোশতাক সামরিক আইন জারি করলেন এবং নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিলেন।
ক্ষমতা গ্রহণের সময় প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ফলে তার সেই সরকারে ১২ জন মন্ত্রী এবং ১১ জন প্রতিমন্ত্রী থাকলেও কোন প্রধানমন্ত্রী পদ ছিল না। এই মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়া বেশিরভাগই ছিলেন আগের মন্ত্রিসভার সদস্য।
নিজে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণের পরেই উপরাষ্ট্রপতি করেন শেখ মুজিব সরকারের ভূমিমন্ত্রী মোহাম্মদ উল্লাহকে।
গ্রেপ্তার অভিযান
আনোয়ার উল আলম তার ‘রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা’ বইয়ে লিখেছেন, ”খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতা গ্রহণ এবং মন্ত্রিসভা গঠন করেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেপ্তার করতে থাকেন। ২৩শে অগাস্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, এম মনসুর আলী, আবদুস সামাদ আজাদসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে যারা তাকে সমর্থন করতে এবং তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকার করেন, তাঁদের বন্দী করেন।”
মেজর জেনারেল (অবঃ) মইনুল হোসেন চৌধুরী ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইতে লিখেছেন, ”ক্ষমতায় এসেই এই সরকার তাড়াহুড়ো করে সামরিক বাহিনীতে পরিবর্তন আনে। জেনারেল ওসমানীকে (এমএজি ওসমানী) একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা করা হলো। উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হলো। আর পূর্বতন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অব্যাহতি দিয়ে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলো রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের জন্য।”
”মেজর রশিদ, ফারুক এবং তাদেরই সহযোগীদের হাবভাব ও চালচলন দেখে মনে হতো, দেশ এবং সেনাবাহিনী তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। মেজর ফারুক বঙ্গভবনের একটি কালো মার্সিডিজ গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াত। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় এবং অন্যান্য অনিয়মের অভিযোগ ছিল। খন্দকার মোশতাক এদেরকে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য বঙ্গভবনেই থাকতে উৎসাহিত করতেন।” লিখেছেন মইনুল হোসেন চৌধুরী।
ক্ষমতা দখল করার পর থেকেই হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তা এবং নতুন সরকারের সদস্যদের জন্য একটি উদ্বেগের কারণ ছিল রক্ষীবাহিনী। তাই অগাস্টেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত করে সামরিক বাহিনীর সাথে একীভূত করে ফেলা হবে।
সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে খন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এম এ জি ওসমানী রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের ডেকে এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন।
জয় বাংলার বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ
স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই বাংলাদেশের জয় বাংলা অনেকটা জাতীয় শ্লোগান হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। স্বাধীনতার পরে এই শ্লোগানই ব্যবহৃত হতো। কিন্তু খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়েই তার প্রথম বক্তব্যে ‘জয় বাংলা’র বদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলতে শুরু করেন।
পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্তন করে রেডিও পাকিস্তানের অনুকরণে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ নাম নির্ধারণ করেন।
জাতীয় পোশাক
সেই সময়ের পত্রপত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, ছয়ই অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, রাষ্ট্রীয় পোশাক হবে খন্দকার মোশতাক আহমেদ সবসময়ে যা পরে থাকতেন, সেই আচকান ও শেরওয়ানি।
কোন কোন গবেষক লিখেছেন, মোশতাক যে টুপিটি মাথায় পরতেন, সেই টুপিটিকে জাতীয় টুপি ঘোষনা করা হয়।
বলা হয়, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে এই টুপি ও পোশাক পরে যোগদান করতে হবে।
চৌঠা অক্টোবর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গেও কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু করা হয়।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ বা বিচার যাতে না করা যায়, সেই দায়মুক্তি দিয়ে ২৬শে সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন।
পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বাংলাদেশের সংসদে সেই অধ্যাদেশ অনুমোদন করা হয়। ফলে সেটি একটি আনুষ্ঠানিক আইন হিসাবে অনুমোদিত হয়।
১৯৭৯ সালের সাতই জুলাই বাংলাদেশের সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী করে সেটি সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে হত্যাকাণ্ডের ২১ বছরের মধ্যে হত্যাকারীদের কারও কোন বিচার হয়নি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর ১২ই নভেম্বর ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে পার্লামেন্ট। ২০১০ সালে পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশের হাইকোর্ট।
কারাগারে নিহত চার নেতা। ঘড়ির কাঁটার ক্রমানুসারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান
জেল হত্যা
তেসরা নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে একদল সেনা সদস্য। সেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের নির্দেশে।
২০১০ সালে বিবিসি বাংলার কাছে সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার আমিনুর রহমান বলেছেন, “টেলিফোনে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবে আইজি সাহেবের সাথে। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে খবর দিলাম। কথা শেষে আইজি সাহেব বললেন যে প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলছে আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা কর।”
চার নেতাকে একটি কক্ষে একত্রিত করার পর গুলি করে হত্যা করে সেই সেনা সদস্যরা।
তেসরা নভেম্বরেই খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ছয়ই নভেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অবশ্য জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেয়ার পর পরের বছর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার