ওসির পছন্দের এসআই দিয়ে গড়ে তুলেছেন ঘুস সিন্ডিকেট

Daily Ajker Sylhet

দৈনিক আজকের সিলেট

০৪ মার্চ ২০২৫, ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ


ওসির পছন্দের এসআই দিয়ে গড়ে তুলেছেন ঘুস সিন্ডিকেট

মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা:
মানিকগঞ্জের সিংগাইর থানার ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ছয় মাসে কোটি টাকা ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি পছন্দের উপপরিদর্শক (এসআই) দিয়ে থানায় গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট বাহিনী। তাদের দিয়েই ৬ মাসে তিনি প্রায় কোটি টাকা গ্রেফতার বাণিজ্য করেছেন। যোগদানের পর থেকে তার বিরুদ্ধে উঠেছে একের পর এক অভিযোগ। পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে এ পর্যন্ত তাকে ৩ বার শোকজ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে ওসির সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য এসআই সুমন চক্রবর্তীকে শিবালয় থানায় বদলি করা হয়েছে। এছাড়া এসআই মুত্তালিব হোসেনকে দৌলতপুর থানায় বদলি করা হয়েছে এবং এসআই মাসুদুর রহমানের বদলি আদেশ হয়েছে।

বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সিংগাইর থানার ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর যোগদানের পর থানায় ঘুস বাণিজ্যের বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তার মনোনীত ৩ উপপরিদর্শক (এসআই) সুমন চক্রবর্তী, মাসুদুর রহমান মাসুদ, মুত্তালিব হোসেনকে দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে তাদের হত্যা মামলায় ফাঁসানোর নামে অভিনব কায়দায় ঘুস বাণিজ্যে চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদন এবং যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেশ কিছু ঘটনার সত্যতাও মেলে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে সিংগাইর থানার তালেবপুর ইউনিয়নের কাংশা গ্রামে মুক্তার হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে চুরির অপরাধে আটক করে স্থানীয়রা। এরপর রাতভর তাকে নির্যাতন করা হলে সকালে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় জড়িত প্রান্ত, নবু ও যুবায়ের নামে তিনজনকে আটক করে এসআই সুমন। পরে ওসির নির্দেশে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এছাড়া বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জামসা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. আতিককে আটক করে এসআই সুমন চক্রবর্তী। পরে এসআই সুমন ওসির সঙ্গে যোগসাজশে আতিকের পরিবারের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। একইভাবে ধল্লা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইউনুসকে আটক করে এসআই সুমন। ইউনুসকেও হত্যাসহ একাধিক মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে ১ লাখ টাকা আদায় করে।

এদিকে গত বছরের ১৮ অক্টোবর সিংগাইর উপজেলার ভাকুম এলাকার ভাই-ভাই জেনারেল স্টোরের মালিক মো. জয়নালের বিরুদ্ধে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ করে স্থানীয়রা ৯৯৯-এ ফোন করে। পরে ওসির নির্দেশে তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসেন এসআই সুমন ও মাসুদুর রহমান। আটক জয়নালের পরিবারের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে ৫৪ ধারায় তাকে আদালতে পাঠানো হয়।

সিংগাইর উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ওয়াসিমকে আটক করে এসআই সুমন। তাকে হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে তার পরিবারের কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় এসআই সুমন।

উপজেলার চর আজিমপুর এলাকার মহসীন খানকে আটক করে থানায় এনে বিভিন্ন মামলায় জড়ানোর ভয়ভীতি দেখায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মহসীনকে হত্যা মামলায় না জড়িয়ে ধল্লা পুলিশ ফাঁড়ি পোড়ানো মামলায় দিয়ে রিমান্ড না চাওয়ার শর্তে এসআই সুমনকে ৮০ হাজার টাকা উৎকোচ দেয় মহসীনের স্ত্রী।

এছাড়া ধল্লা বাজারের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী রমজানকে আটক করে থানায় এনে একাধিক মামলায় না দেওয়া এবং রিমান্ড না চাওয়ার শর্তে রমজানের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় এসআই সুমন। এরপর রমজানকে পুলিশের ফাঁড়ি পোড়ানো মামলায় আদালতে পাঠানো হয়। তালেবপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শাহানুর বক্সকে আটক করে ৪০ হাজার টাকা উৎকোচ নেয় এসআই সুমন।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসআই সুমন চক্রবর্তী, মুত্তালিব, মাসুদুর রহমান মাসুদের কাছের মানুষ সিংগাইর থানার ওসি জাহিদুল রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতার আসামিদের হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

বিভিন্ন আসামিকে আটকের পর তাদের আত্মীয়স্বজনরা থানায় এলে তাদের রাত ১০টার পরে থানার সামনের স্কুল মাঠে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন শর্তে অর্থ আদায় করে সিন্ডিকেটের সদস্য এসব এসআই। অবস্থাভেদে আসামিদের কাছ থেকে তারা ৩০ হাজার থেকে শুরু করে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে থাকে। এছাড়া আসামি ধরার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মামলার বাদীর কাছ থেকেও অর্থ আদায় করে ওসির সিন্ডিকেট বাহিনী।

জানা গেছে, রামকান্তপুরের ছাত্তারের কাছ থেকে ৭০ হাজার, সিংগাইর বাজারের ব্যবসায়ী শাহীন বক্সের কাছে ৩০ হাজার, বাইমাইলের তসলিমুদ্দিন স্বপনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা আদায় করেছে এ চক্র। এরা সবাই ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের বর্তমান ও সাবেক পদধারী নেতা। কিছুদিন আগে সাভার থেকে ৫ থেকে ৬ জনকে গ্রেফতার করে মোটা অঙ্কের ঘুস নিয়ে সহজ জামিনযোগ্য মামলায় আদালতে পাঠিয়েছে। এরপর তাদের জামিন হলে জেলগেট থেকে ফের গ্রেফতার করে অন্য মামলায় চালান দেওয়া হয়।

এছাড়া সিংগাইর পৌরসভার আজিমপুর এলাকার সাঈদ ওরফে পোকা সাঈদকে গ্রেফতারের পর ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর নিজের রুমে নিয়ে বাকি সবাইকে বের করে দিয়ে ২০ লাখ টাকা দাবি করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থানায় দালালি করা সাঈদকে হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। ভয়ে ১ লাখ টাকা দিতে রাজি হয় সাঈদ। পরে রাতের আঁধারে সাঈদের স্ত্রী থানায় গিয়ে সেই টাকা পৌঁছে দেয়। এ ঘটনায় স্থানীয়দের মাঝে কানাঘুষা শুরু হলে পরে তাকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। জামিনে বের হয়ে পুনরায় গ্রেফতারের ভয়ে আবারও ওসিকে ৫০ হাজার টাকা দেয় সাঈদ। বর্তমানে এই সাঈদের মাধ্যমে সিংগাইরের আওয়ামী লীগের পালিয়ে থাকা নেতাদের কাছ থেকে গোপনে অর্থ আদায় করছে ওসি জাহিদুল।

উপপরিদর্শক (এসআই) সুমন চক্রবর্তী বলেন, আমি সিংগাইর থানায় থাকাকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশ কিছু অভিযান চালিয়েছি। আমি কোনো মামলার তদারকি কর্মকর্তা নই। আমি কাউকে আটক বা গ্রেফতার করে কোনো টাকা-পয়সা নেইনি। আর চোর হত্যা মামলায় যে ৩ জনকে আটক করা হয়েছিল তাদের ওসি এবং সার্কেল স্যারের নির্দেশে মুচলেকার মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে আমি কোনো ধরনের লেনদেন করিনি।

আরেক উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদুর রহমান মাসুদ বলেন, আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। তিনি বলেন, কিছু জানার থাকলে আপনি সরাসরি আমার কাছে আসেন।

সিংগাইর থানার ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর বলেন, আপনি দেখবেন অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর সিংগাইরের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রয়েছে। যে কোনো এলাকায় জিজ্ঞেস করতে পারেন যে, ওসি কারও কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা নিয়েছে কিনা। যে বা যারা ওসির গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগ তুলেছে তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।

সহকারী পুলিশ সুপার (সিংগাইর সার্কেল) নাজমুল হাসান বলেন, তাদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সেগুলো জানানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২ জন এসআইকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে এবং আরেকজনের বদলি প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলমান রয়েছে।

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 988 বার